পাগলী বলে পাননি আশ্রয়, তবুও আয়ের টাকা দান করেন মসজিদ-এতিমখানায়

সংবাদপত্র বিক্রি ক’রে জীবন কাটাচ্ছেন দীল আফরোজ খুকি। প্রা’য় ৪০ বছর ধ’রে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হেঁটে রাজশাহী নগরীর বিভিন্ন এলাকায় সংবাদপত্র বিক্রি ক’রেন তিনি। শহরের একমাত্র নারী সংবাদপত্র বিক্রেতাও তিনি।

কিশোরী বয়সে ৭০ বছরের এক বৃ’দ্ধের স’ঙ্গে খুকির বিয়ে হয়েছিল। মাস যেতে না যেতেই স্বা’মী মা’রা যান। ১৯৮০ সালে স্বা’মীর মৃ’ত্যুর পর পরিবার আত্মীয় স্বজন তাকে গৃহ ছাড়া ক’রেন। ভাইদের আপত্তিতে বাবার বাড়িতেো তার জায়গা হয়নি তার। এরপর থেকেই কিছুটা মা’নসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন তিনি।

পাগলী বলে তাকে কেউ আশ্রয়ও দেয় না। এমনকি অনেকে মা’রধ’রও ক’রে। তবুও কারো দয়ার পাত্রী না হয়ে বেছে নেন সংবাদপত্র বিক্রির পেশা। বড় কোনো স’মস্যা তাকে কাবু ক’রতে না পারলেও মাঝমধ্যে ছোটখাটো স’মস্যাগুলো তাকে অস’হায় ক’রে দেয়। এরপরো কোনো লোভ- লা’ল’সা নেই খুকির।

একদিন মানিব্যাগ ফিরিয়ে দিয়ে মালিকের কাছ থেকে ১৫০ টাকা বকশিস পান খুকি। পুরো রাজশাহীর মানুষকে সেদিন বলেছেন, আমি সবার চেয়ে ধনী। আমা’র কাছে ১৫০ টাকা আছে। তোমাদের কারো কাছে এতো টাকা আছে? খুকি জা’নান, স্থা’নীয় ও জাতীয় দৈনিকসহ প্রতিদিন ৩০০ পত্রিকা তিনি বিক্রি ক’রেন।

এ থেকে প্রতিদিন তার আয় ৩০০ টাকা। এই টাকা থেকে কিছু নিজে’র খরচ মাত্র ৪০ টাকা। বাকি টাকা থেকে ১০০ টাকা দেন একটি এতিমখানায়, ৫০ টাকা মসজিদ-মন্দিরে, ১০ টাকা ভিক্ষুকদের আর হজে যাওয়ার জন্য ১০০ টাকা একটি ব্যাংকে রাখেন। প্রতিদিন সকালে তার শিরোইল মহল্লার বাসা থেকে বের হয়ে হেঁটে রাজশাহী মহানগরীর,

রেলগেট মা’র্কে’টে পত্রিকার এজেন্টদের কাছ থেকে পত্রিকা ক্রয় ক’রেন। তারপর সেখান থেকে হেঁটে হেঁটে রাজশাহীর রেলস্টেশন, শিরোইল বাস টার্মিনাল, সাগরপাড়া, আলুপট্টি, সাহেব বাজার, আরডিএ মা’র্কেট ও নিউ মা’র্কে’টে পত্রিকা বিক্রি ক’রেন। এইসব স্থানে তার কিছু নিয়মিত কাস্টমা’র আছে তাদের কাছে পত্রিকা বিক্রি,

ক’রেন আবার সড়কে চলাচলকৃত বা বাজারে কেনাবেচা ক’রতে আসা মানুষদের কাছে নিয়ে গিয়েও পত্রিকা কিনতে অনুরো’ধ ক’রেন। এদের মধ্যে অনেকে পত্রিকা নেন আবার অনেকে পত্রিকা নেন না। তবে পত্রিকা বিক্রির বিনিময়ে তিনি কখনো অতিরি’ক্ত কোনো টাকা পয়সা নেন না।

দিল আফরোজ বলেন, আগে বেশি পত্রিকা বিক্রি হতো। লোকজনের কাছে গেলে পত্রিকা নিতো। এখন কম পত্রিকা বিক্রি হয়। লোকজন তেমন পত্রিকা কিনতে চায় না।’ তারপরও আমৃ’ত্য এই পেশার সাথে থেকেই জীবনের শেষ নিঃশ্বা’স ত্যা’গ ক’রতে চান তিনি।

পত্রিকার ক্রয় ক’রার সময় এজেন্টদের স’ঙ্গে তার লেনদেনও ভালো। টাকাপয়সা কখনো বকেয়া রাখেন না বলে জা’নালেন পত্রিকার এজেন্টরা। দাম প’রিশোধ ক’রেই তিনি পত্রিকা ক্রয় ক’রেন।

রাজশাহীর স্থা’নীয় দৈনিক সানশাইনের সার্কুলেশন ম্যানেজার লিটন ইসলাম বাবু জা’নান, আমি ১৩ বছর ধ’রে খুকি আপাকে দেখছি আমা’র কাছ থেকে পত্রিকা নিতে। কখনো কোনো বকেয়া রাখেন নি তিনি। আগে টাকা প’রিশোধ ক’রে তারপর পত্রিকা কিনেন। দুই তিন বছর আগেও সানশাইন পত্রিকা নিতো একশো কপির মতো। এখন কখনো তিরিশ কপি কখনো ২০ কপি নেন।

রাজশাহীর আরেকটি স্থা’নীয় দৈনিক সোনালী সংবাদের সার্কুলেশন ম্যানেজার হারুণও জা’নালেন টাকা পয়সা প’রিশোধ ক’রেই তারপর পত্রিকা কিনেন খুকি। তার পত্রিকাও আগে দেড়শো কপির মতো কিনলেও বর্তমানে ৩০ থেকে ৫০ কপির মতো কিনেন বলেন জা’নান তিনি।

রাজশাহী হকার্স শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি জামিউল করিম সুজন জা’নান, আমি ২০০০ সালে পত্রিকা বিক্রির সাথে যু’ক্ত হই। তখন থেকেই খুকি আপাকে দেখছি পত্রিকা কিনে নিয়ে গিয়ে বিক্রি ক’রতে।

তবে খুকির পরিচিত আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশিরা বলছেন, কিছুটা মা’নসিক ভারসাম্যহীন এই নিঃসন্তান নারী। তার স্বা’মীর মৃ’ত্যুর পর থেকে আরো একগুয়ে স্বভাবের হয়ে উঠেন তিনি। বাবার কাছ থেকে পাওয়া জমিতে বাড়ি তৈরি ক’রে একাই থাকেন। কারো কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা নেন না। স্বা’মীর মৃ’ত্যুর পর থেকে পত্রিকা বিক্রি ক’রেই জীবিকা নির্বাহ ক’রেন।

একই মহল্লার সত্তরোর্ধ্ব আব্দুল কাদির বলেন, আমা’র ছোট বোনের বান্ধবী খুকি। বিয়ের পর স্বা’মী মা’রা যাবার পর থেকেই সে কিছুটা মা’নসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে প’ড়ে। তারপর থেকে তাকে পত্রিকা বিক্রি ক’রতে দেখি। আমিও তার নিয়মিত গ্রাহক। প্রতিদিন সকালে আমাকে পত্রিকা দিয়ে যায়।

দিল আফরোজে’র বড় বোনের বাড়ি তার বাড়ির পাশেই। তার বড় বোনের ছেলে শামস উর রহমান বলেন, খালা বহুবছর ধ’রে পত্রিকা বিক্রির স’ঙ্গে জড়ি’ত। তাকে নি’ষেধ ক’রা হলেও শুনেন না। কতোজনের কাছ থেকে যে তার খালা পত্রিকা বিক্রির টাকা পাবে তার হিসেব নেই।